ইরানের ৫৬ বছর বয়সী কলসুম আকবরীর বিরুদ্ধে ২২ বছর ধরে ১১ জন স্বামীকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। তবে তিনি দাবি করেন যে সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে; তিনি ঠিক মনে করতে পারছেন না। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সম্পত্তি, টাকার জন্য তিনি তার স্বামীদের হত্যা করেছেন বলে জানা যায়। এই ঘটনা সামনে আসার পর একেবারে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে মিডিয়া সবখানেই।
তবে জানেন কি? ১৮ শতকে এমন এক নারী ছিলেন যিনি তার দুই স্বামী, ৬ সন্তানসহ প্রায় ৩০জন প্রেমিককে হত্যা করেছিলেন। বিষ প্রয়োগ এবং আরও নানান কৌশলে তিনি এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটান। কিন্তু তিনি পুলিশের হাত থেকে বারবার বেড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন এবং তার শেষ পরিণতি কি হয়েছিল তা আজও রহস্য।
এই নারী ইতিহাসে লেডি ব্লুবার্ড নামে খ্যাত। তার আসল নাম বেলে গুনেস। রূপকথায় ‘ব্লুবার্ড’ নামটা হয়তো প্রেম ও রহস্যের প্রতীক। কিন্তু ইতিহাসে যখন ‘লেডি ব্লুবার্ড’ বলা হয়, তখন তার অর্থ একেবারেই ভিন্ন। বেলে গুনেস নিজের স্বামী, সন্তান এমনকি প্রেমিকদেরও নির্মমভাবে হত্যা করে ‘লেডি ব্লুবার্ড’ খ্যাতি পেয়েছিলেন।
১৮৫৯ সালের ১১ নভেম্বর নরওয়েতে বেলে গুনেসের জন্ম। বেলের পরিবার ছিল খুবই দরিদ্র। তবে ভাগ্য ফেরাতে ২৩ বছর বয়সে বেলে চলে আসেন আমেরিকায়। নতুন দেশে এসে এক কসাইয়ের দোকানে কাজ শুরু করেন। পরিশ্রমী, শান্ত স্বভাবের তরুণী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন তিনি।
এখানে এসে তার পরিচয় হয় ম্যাড সোরসান নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। এরপর তাদের প্রেম ও পরিণয়। ১৮৯৩ সালে তারা বিয়ে করেন। বেলে তার স্বামীর সঙ্গে মিলে একটি কনফেকশনারি দোকান চালাতেন। কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের চার ছেলে-মেয়ের জন্ম হয়। ক্যারোলিন, এক্সেল, মার্টল আর লুসি নাভে। এছাড়াও জেনি নামের একটি মেয়েকে তারা দত্তক নিয়েছিলেন। মোট ৫ সন্তান নিয়ে বেশ সুখেই কাটছিল বেলের সংসার।
হঠাৎ করেই বেলের দুই ছেলে-মেয়ে মারা যান। পেটের ব্যথায় তাদের মৃত্যু হয় বলে সবাই জানত। এর কিছুদিন পর তাদের কনফেকশনারি দোকানে আগুন লেগে পুড়ে যায় সবকিছু। দিশেহারা অবস্থা বেলের। বেলে আর তার স্বামীর দোকানের যে বীমা করা ছিল; সেই টাকা পান কয়েকদিনের মধ্যে। এ ছাড়াও যে দুই সন্তান মারা গেছেন, তাদের জীবন বীমার টাকাও পান তারা।
তবে রহস্যজনকভাবে যেদিন তারা টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন; সেদিনই বেলের স্বামী ম্যাড সোরসান মারা যান। সবকিছুই আশেপাশের মানুষের কাছে কিছুটা অদ্ভুত লাগছিল। বেলের পরিবারের ওপর এত ঝড়-ঝাপটা যাচ্ছে অথচ বেলের চোখেমুখে কেমন যেন তৃপ্তির হাসি।
ম্যাড সোরসানের পোস্টমর্টেম দেখে চিকিৎসকরা সন্দেহ করতে থাকেন বেলেকে। কারণ তার শরীরে এক ধরনের রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। যেই রাসায়নিক পাওয়া গিয়েছিল বেলের মারা যাওয়া দুই সন্তানের শরীরেও। যদিও বেলে এগুলোর কিছুই পাত্তা দিচ্ছিলেন না। বারবার স্বামীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে হার্ট অ্যাটাককে দায়ী করেছিলেন তিনি। পুলিশ স্বামী-সন্তানের হত্যার দায়ে গ্রেফতার করে বেলেকে।
আসলে এটিই ছিল বেলের শুরু। নিজের সন্তানকে দিয়েই মানুষ হত্যার বনি করেছিলেন তিনি। যদিও এই হত্যার সঙ্গে তার স্বামীও জড়িত ছিলেন। মূলত জীবন বীমার টাকা পেতেই তারা সন্তানদের হত্যা করেন। একই কারণে নিজেদের দোকানও পুড়িয়ে দেন। টাকা পাওয়ার পর নিজের স্বামীকেও হত্যা করেন বেলে। অত্যন্ত বিষাক্ত, বর্ণহীন বিষ দিয়েই স্বামী এবং সন্তানদের হত্যা করেছিলেন তিনি।
পুলিশের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ না থাকায় কিছুদিন পরই বেলে ছাড়া পেয়ে যায়। বাকি তিন সন্তানকে নিয়ে চলে যান ইন্ডিয়ানাতে। সেখানে ৪২ একরের একটা ফার্ম কিনে নেন। তবে এই ফার্ম তিনি সুখে-শান্তিতে সন্তানদের নিয়ে বাকি জীবন কাটানোর জন্য কেনেননি। বরং এই ফার্মই পরে পরিচিতি পেয়েছিলো ‘দ্য ডেথ গার্ডেন’ হিসেবে। এই বাগান বাড়িতেই তিনি তার বেশিরভাগ খুন করেছিলেন।
এই ফার্ম কেনার কয়েকদিন পরই ফার্মের একাংশ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। একইভাবে বীমার টাকা আদায় করেন। এখানে এসে পিটার গুনেস নামের এক ব্যক্তিকে বিয়ে করেন ১৯০২ সালের পহেলা এপ্রিল। পিটারের এর আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল। সেই সংসারে তার দুই মেয়েও আছে। তাদের নিয়ে বেলের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন।
কিছুদিন পরই ছোট মেয়েটির রহস্যজনক মৃত্যু হয়। পিটার কিছুটা সন্দেহ করেছিলেন যে, কিছু একটা গড়বড় আছে। তখন তিনি তার বড় মেয়ে সোয়ানহিল্ডকে আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দেন। এটি ছিল তার সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত। কারণ শুধু এ মেয়েটিই বেলের হাত থেকে বাঁচতে পেরেছিলেন।
পিটার মারা যান পরের বছরই। অর্থাৎ ১৯০৩ সালে। বলা হয় রান্নাঘরের জাঁতাকল মাথায় পড়ে তিনি মারা গেছেন। কিন্তু পিটারের বড় মেয়ে জেনি খুনটা দেখে ফেলেছিল। এ কথা সে তার এক বান্ধবীকেও বলে, যে তার মা-ই তার বাবাকে জাঁতাকল দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।
পোস্টমর্টেমের সময় আবারো মৃতের শরীরে স্ট্রিকনাইনের সন্ধান পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, প্রথমে বিষ প্রয়োগ করে পরে দুর্ঘটনা সাজানো হয়েছিল। কিংবা মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্যও বিষ প্রয়োগ করা হয়ে থাকতে পারে। অবশ্য স্বামীর মৃত্যুর পর বেলের আহাজারি দেখে কেউই তাকে খুনি ভাবতে পারেনি।
পিটারের মৃত্যুর কিছুদিন পরেই বেলে তার জীবন বীমার টাকা তুলে ফেলেন। এর ৬ মাস পরই একটি ছেলেসন্তানের জন্ম দেন বেলে। তার নাম রাখেন ফিলিপ গেনেস। এরপর থেকে শুরু করেন নতুন এক উপায়। খুন করা যে নেশা হয়ে গিয়েছিল তার। একদিকে টাকার লোভ; অন্যদিকে খুনের নেশা। তবে বেলে আর বিয়ের পিঁড়িতে বসেননি।
এবার পত্রিকায় বিয়ের বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করেন। যেখানে লেখা থাকত, ‘এক ধনী, সুন্দরী বিধবা নারী সচ্ছল উপযুক্ত সঙ্গী খুঁজছেন’। বিজ্ঞাপনে শর্ত থাকতো, বিয়েতে আগ্রহী পুরুষকে অবশ্যই তার সেভিংসের টাকা নগদ নিয়ে কনে দেখতে আসতে হবে। সুন্দরী বেলের সেই প্রস্তাবে সাড়াও দিয়েছেন অনেকে। এ বিজ্ঞাপন দেখে অনেক পুরুষই টাকা নিয়ে বেলের ফার্মহাউজে যেতেন। কিন্তু আর ফিরে আসতেন না।
লোকচক্ষুর আড়ালে বেলের ফার্মহাউস রূপ নেয় এক মৃত্যু কারখানায়। ধারণা করা হয়, তিনি অন্তত ৩০ জন পুরুষকে হত্যা করেছিলেন। তার কৌশল ছিল সহজ-প্রথমে ভালোবাসা, তারপর বিষ বা কুঠারের আঘাত। এরপর মৃতদেহ পুঁতে রাখতেন বাড়ির পেছনের জমিতে।
বেলে দেখতে যেমন সুন্দরী ছিলেন; তেমনি ছিলেন স্বাস্থ্যবান। তার উচ্চতা ছিল ৬ ফিট। খুব সহজেই যে কোনো পুরুষকে ধরাশায়ী করে ফেলতে পারতেন। জন মু, হেনরি গারহোল্ট, ওলফ সেভেনহার্ড, ওল বি বাডসবার্গ, ওলাফ লাইন্ডব্লুম, আন্দ্রে হেগেলিন নামের ব্যক্তিদের হত্যা করেছেন তিনি। এই তালিকায় আরও অনেক মানুষই আছেন, যারা খুন হয়েছেন বেলের হাতে। তবে তাদের সঠিক পরিচয় ও সংখ্যা জানা যায়নি।
১৯০৮ সালে বেলের এই রহস্য ফাঁস হয় আন্দ্রে হেগেলিনকে হত্যার পর। আন্দ্রে হেগেলিন নিখোঁজ হওয়ার পর তার ভাই তার খোঁজ নিতে শুরু করেন। আন্দ্রে হেগেলিনেরর অন্তর্ধান নিয়ে তদন্ত শুরু হয়। এদিকে বেলের ফার্মহাউজ আগুনে পুড়ে ছাই। উদ্ধারকারীরা বেলের তিন সন্তানের পুড়ে যাওয়া লাশ পেলেন। পাশেই পড়েছিল আরেকটি মাথাবিহীন লাশ। তবে সেটা বেলের লাশ ছিল না। কারণ বেলে ছিলেন দীর্ঘদেহী, অন্যদিকে গলাকাটা লাশটা ছিল ক্ষীণ দেহের। তাহলে বেলে কোথায়?