দেশের বেসরকারি খাতের সর্ববৃহৎ ইসলামী ব্যাংকে হচ্ছেটা কী? ব্যাংকটিতে সম্প্রতি পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগকৃত কর্মীদের মূল্যায়ন ও ছাঁটাইকে কেন্দ্র করে নতুন অস্থিরতা দেখা দেয়। একদিকে চাকরি ফেরত ও ওএসডি বাতিলের দাবিতে রাস্তায় আন্দোলন করছে একটি পক্ষ। অন্যদিকে এস আলম গ্রুপের নিয়োগপ্রাপ্ত অদক্ষ কর্মকর্তাদের বহিষ্কারের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে আরেক পক্ষ। যার কারণে ইসলামী ব্যাংকে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ড সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন সাধারণ গ্রাহকরা।
১৯৮৩ সালের ১৩ মার্চ দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম শরিয়াহভিত্তিক এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিছু সৎ ও দক্ষ মানুষের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই ব্যাংক খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। পর্যায়ক্রমে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এই ব্যাংকের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী, আমানতকারী, বিনিয়োগ গ্রাহক, বিশেষ গ্রাহক কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে। সৎ পরিচালনা পর্ষদ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের সততার কারণে আমানত-বিনিয়োগে একপর্যায়ে শীর্ষ অবস্থান লাভ করে ব্যাংকটি। এটি দেশের বেস্ট ব্যাংক, বেস্ট ইসলামিক ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন হিসেবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেকবার অ্যাওয়ার্ড লাভ করে।
তবে ব্যাংকটির এই সাফল্যে কুনজর পড়ে কালো শকুনের। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের হস্তক্ষেপে সৎ মানুষদের কাছ থেকে ব্যাংকটি ছিনিয়ে নেয় লুটেরা গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এস আলম। আলোচিত গ্রুপটির সীমাহীন লুটপাটে দুর্বল হয়ে পড়ে ব্যাংকটি। ছাত্রজনতার আন্দোলনের মুখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর পালিয়ে যায় লুটেরা গোষ্ঠী ও তার দোসররা। ২২ আগস্ট এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে ব্যাংকটির জন্য পাঁচ সদস্যের নতুন পর্ষদ গঠন করে দেওয়া হয়। নতুন পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদকে। চেয়ারম্যান হওয়ার পর সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে এস আলমের সাথে যোগাযোগ ও তাদের হয়ে বিভিন্ন জায়গায় লবিংসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। অবশেষে গত ১৭ জুলাই তিনি পদত্যাগ করেন।
ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ পদত্যগের পর ২৩ জুলাই ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন প্রফেসর ড. এম জুবায়দুর রহমান। এছাড়াও গত ৩ আগস্ট ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে নিয়োগ পান মো. ওমর ফারুক খান। তারা দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ইসলামী ব্যাংক সংস্কার কাজে হাত দেন। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পরীক্ষা ছাড়াই বিপুলসংখ্যক কর্মী নিয়োগ করা হয়। যাদের অনেকের ছিল না ন্যূনতম যোগ্যতা, দক্ষতা, এমনকি ভদ্রতাও। এস আলমসহ বিভিন্ন শিল্প মালিক ও নেতার সুপারিশে নিয়োগ পাওয়ায় এসব কর্মীর দাপটই ছিল আলাদা। নিয়োগ পাওয়া এই কর্মকর্তাদের বেশির ভাগই একটি এলাকাকেন্দ্রিক। সম্প্রতি বিভিন্ন ব্যাংকে নিয়োগ পাওয়া এসব কর্মীর মূল্যায়ন পরীক্ষা নিতে গেলে বাঁধে বিপত্তি। এর প্রভাবে ইসলামী ব্যাংকসহ পুরো ব্যাংক খাতেই বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।
ইসলামী ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংকের মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ২১ হাজার। এর মধ্যে ২০১৭ সাল থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত নিয়োগ দেওয়া হয় প্রায় ১১ হাজার। এদের বেশির ভাগেরই কোনো ধরনের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ কিংবা মূল্যায়ন পরীক্ষাও নেওয়া হয়নি। এসব কর্মীর মধ্যে শুধু চট্টগ্রাম জেলার সাত হাজার ২২৪ জন। যার মধ্যে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের নিজ উপজেলা পটিয়ার বাসিন্দা চার হাজার ৫২৪ জন। ওই সময় ইসলামী ব্যাংক এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
জানা গেছে, ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগ গত ১৪ আগস্ট পরীক্ষার তারিখ ২৯ আগস্ট নির্ধারণ করে। পরে ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার মো. হানিফ ২৭ আগস্ট হাইকোর্টে রিট করলে আদালত বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ পর্যালোচনা করে ২৫ সেপ্টেম্বর জানায়, ইসলামী ব্যাংক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তাই কর্মীদের চাকরি, নিয়োগ ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া তাদের নিজস্ব এখতিয়ারে। তবে সিদ্ধান্তগুলো অবশ্যই দেশের প্রচলিত আইন ও বিধিবিধানের মধ্যে হতে হবে। এ সিদ্ধান্তের আলোকে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা গ্রহণ করে, যা গত শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টায় অনুষ্ঠিত হয়। এতে মোট ৫ হাজার ৩৮৫ কর্মীর অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ৪১৪ জন অংশ নেন এবং তারা নিয়মিত অফিসও করেছেন। তবে বাকি ৪ হাজার ৯৭১ জন পরীক্ষা এড়িয়ে পরদিন অফিসে হাজির হন। এদের মধ্যে ২০০ জনকে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং বাকি ৪ হাজার ৭৭১ জনকে তাদের কাজ থেকে বিরত রাখা হয়েছে।
পরীক্ষা আয়োজনের আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর ইসলামী ব্যাংক থেকে একটি নোটিশ জারি করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক বলে জানানো হয়। তবে পরীক্ষার দিন বহু কর্মী পরীক্ষায় না বসে বর্জন কর্মসূচি পালন করেন। গত ২ অক্টোবর মূল্যায়ন পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করে ইসলামী ব্যাংক। কর্মকর্তাদের জন্য অনুষ্ঠিত বিশেষ যোগ্যতা মূল্যায়ন পরীক্ষায় ৮৮ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করেছেন। বাকি ১২ শতাংশ কর্মকর্তার জন্য সক্ষমতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ শেষে পুনর্মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানানো হয়।
এদিকে গতকাল শনিবার (৪ অক্টোবর) চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে ইসলামী ব্যাংকের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এতে সড়কের দুই পাশে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট, ভোগান্তিতে পড়েন হাজারও যাত্রী। পরে পৌনে ১২টার দিকে তারা সড়কে বসে অবরোধ শুরু করেন। এতে শত শত কর্মকর্তা অংশ নেন। অবরোধকারীরা অভিযোগ করেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইসলামী ব্যাংকের প্রায় ৪০০ কর্মকর্তাকে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। পাশাপাশি আরও ৪-৫ হাজার কর্মকর্তাকে ওএসডি করে কর্মস্থলে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। এতে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন, পরিবার নিয়ে পড়েছেন চরম অনিশ্চয়তায়।
এর আগে শুক্রবার (৩ অক্টোবর) সংবাদ সম্মেলন করে চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারা রোববার থেকে টানা কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে শনিবার সকাল থেকেই মানববন্ধন ও অবরোধ কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের আন্দোলন শুরু হয়।
চাকরিচ্যুতরা একদিকে চাকরি ফেরানোর দাবিতে আন্দোলন করছেন। অপরদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংককে বয়কটেরও আহ্বান জানাচ্ছেন। পটিয়া ব্যাংকার অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে তাদের ইসলামী ব্যাংক বয়টের আহ্বান জানাতে দেখা যায়। আবার ইসলামী ব্যাংকের ফেসবুক পেজ হ্যাকড হওয়া নিয়ে উল্লাস করতে দেখা গেছে। সেই গ্রুপগুলোতে চলছে এস আলমেরও গুনগান।
অন্যদিকে এস আলম গ্রুপের অবৈধ নিয়োগপ্রাপ্ত অদক্ষ কর্মকর্তাদের অবিলম্বে বহিষ্কারের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে সচেতন ব্যাংকার সমাজ। রোববার (৫ অক্টোবর) সকাল পৌনে ১০টার দিকে ইসলামী ব্যাংক টাওয়ারের সামনে এই মানববন্ধন ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। একই সময়ে একই দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে ইসলামী ব্যাংক গ্রাহক ফোরাম। সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা বলেন, পটিয়া বাহিনী ও এস আলমের অবৈধ দখলদার চক্রের কারণে ব্যাংকের সর্বত্র অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসিতে এসব নিয়োগপ্রাপ্ত অদক্ষ কর্মকর্তা ব্যাংকের স্থিতিশীল পরিবেশ নষ্ট করছে। এর ফলে ব্যাংকের সম্পদ ক্ষতির ঝুঁকিতে রয়েছে এবং গ্রাহক হয়রানির আশঙ্কা বাড়ছে।
বক্তারা আরও অভিযোগ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামী ব্যাংকের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ দুইবার হ্যাক হওয়ার ঘটনাও এসব দখলদার চক্রের ছত্রছায়ায় ঘটেছে। তারা বলেন, আমরা আর কোনো অরাজকতা দেখতে চাই না, আর কোনো পটিয়া সন্ত্রাসী বা এস আলমের অদক্ষ নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে সহ্য করা হবে না। অবিলম্বে তাদের বহিষ্কার করতে হবে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা ও পরিচালনা নিয়ে প্রথম আলোচনা শুরু হয়। তবে অর্থনৈতিক ঝুঁকি বিবেচনায় সেই আলোচনা খুব বেশি দূর গড়ায়নি। এর মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করলে ইসলামী ব্যাংক দখলের জোর প্রচেষ্টা চালায়। এক পর্যায়ে নিবিড় তদারকির উদ্দেশে ২০১৬ সালে ব্যাংকটিতে চারজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি ব্যাংকটি পুরোপুরি দখলে নেয় লুটেরা গোষ্ঠী।
ইসলামী ব্যাংক দখলের বর্ণনা দিতে গিয়ে তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল মান্নান ‘ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ’ আয়োজিত এক ওয়েবিনারে ভার্চয়ালি অংশ নিয়ে বলেন, ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি ভোরে একটি গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর আমাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে ব্যাংকটি দখলে নেয় এস আলম গ্রুপ। ইসলামী ব্যাংকের একটি অব্যবহৃত প্যাডে লেখা পদত্যাগপত্রে জোর করে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। ওই দিন অনেক রাত পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা অফিস করেছেন। তারা ওই দিনই ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনের কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করতে কাজ করেন। এগুলো কীভাবে হতে পারে একটি দেশের ব্যাংক খাতে। যে ব্যাংক খাত একটি দেশের অর্থনীতির প্রাণ। এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, যাতে ভবিষ্যতে এমনটা ঘটানোর কেউ সাহস না পায়।