থ্রি-ডি সাইচমিক সার্ভেতে ডুপিটিলা, বাতসিয়া, হারারগঞ্জ, জকিগঞ্জ ও সিলেট সাউথ উচ্চ সম্ভাবনাময় গ্যাস ভান্ডার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ওই এলাকাগুলোতে ৩ থেকে ৮ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস মজুদ থাকতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।
অবস্থানগত কারণেও এলাকাগুলো খুবই সুবিধাজনক বলে বিবেচিত। কারণ প্রত্যেকটি এলাকার আশপাশে গ্যাসের পাইপলাইন বিদ্যমান। গ্যাস পাওয়া গেলে অল্প খরচ এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা সম্ভব। যা অন্য অনেক এলাকায় সম্ভব নয়। যেমন ভোলায় উদ্বৃত্ত গ্যাস থাকলেও পাইপলাইন অভাবে আনা যাচ্ছে না। আবার জামালপুরে গ্যাসের ছোট আধার পাওয়া গেলেও অনেক প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। দীর্ঘ পাইপলাইন করতে হবে, সেই পাইপলাইনের খরচ তোলার মতো পর্যাপ্ত গ্যাস রয়েছে কিনা সেটা ভাবতে হচ্ছে পেট্রোবাংলাকে।
বাংলাদেশে চলছে গ্যাসের ভয়াবহ সংকট। বাড়ন্ত চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন বৃদ্ধি থাকল দূরের কথা ধস ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রতিদিনেই ১০ থেকে ৩০ লাখ ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন কমছে। এমন একটি সংকটময় সময়ে মনযোগ কাড়তে ব্যর্থ সিলেট বিভাগের ওই সম্ভাবনাময় গ্যাস আধারগুলো। থ্রি-ডি সাইচমিক সার্ভের রিপোর্টে ডুপিটিলায় দু’টি, বাতসিয়ায় তিনটি, হারারগঞ্জে ৩টি, সিলেট সাউথে দু’টি এবং জকিগঞ্জে একটি কূপ খননের সুপারিশ করা হয়।
এতোদিনে শুধুমাত্র ডুপিটিলায় একটি কূপ খননের জন্য ঠিকাদার নিযুক্ত করা হয়েছে। যাও কি-না সিরিয়ালে সবার শেষে রাখায় অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। যে কূপটি খনন করলে গ্যাস দ্রুত উত্তোলন করা যাবে সেটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন অনেকেই। ডুপিটিলা, বাতসিয়ার মতো কূপগুলোতে অগ্রাধিকার তালিকায় রাখা জরুরি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) প্রকৌশলী একরামুল হক বার্তা২৪.কম বলেছেন, ডুপিটিলায় কূপ খননের ঠিকাদার নিয়োগ হয়েছে। বাতসিয়ায় একটি কূপ খননের ডিপিপি পেট্রোবাংলায় প্রেরণ করা হয়েছে। আর হারারগঞ্জে কূপ খননের ডিপিপি প্রণয়নের কাজ চলছে।
এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, জকিগঞ্জ ও সিলেট সাউথ নিয়ে এখন কোন কাজ শুরু হয়নি।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) মো. আব্দুল মান্নান পাটোয়ারী বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, ডুপিটিলা সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময়। যে কারণে সেখানে ৫০ কূপ খনন প্রকল্পের আওতায় একটি কূপ খনন করা হচ্ছে। চীনা প্রতিষ্ঠান সিসিডিসি কূপটির জন্য ঠিকাদার নিযুক্ত হয়েছে। মাটি ভরাটের কাজ চলছে। ওই কূপে গ্যাস পাওয়া গেলে সেখানে আরও কয়েকটি উন্নয়ন কূপ খনন করা হবে।
এছাড়া ১০০ কূপ খনন প্রকল্পের আওতায় বাতসিয়ায় কূপ খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি রয়েছে তারা যাচাই করছে, যেগুলো কূপের সম্ভাবনা বেশি, সেগুলো আগে করা হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, নিয়মের বেড়াজালে আমাদের হাত-পা বাঁধা। বিশাল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রথমে প্রাক-সমীক্ষা করতে ৩ থেকে ৪ বছর লেগে যায়। এরপর ডিপিপি তৈরি করে অনুসন্ধান কূপ খননে লাগে আরও ৫ বছরের মতো।
কূপে গ্যাস পাওয়া গেলে তারপর আরও ৫ বছর লেগে যায় উন্নয়ন কূপ এবং পাইপলাইন করতে। একটি ধাপের ফলাফল পাওয়ার পর আরেক ধাপের কাজ শুরু করতে হয়। খাতা-কলম কেনার প্রক্রিয়া যেমন এখানেও একই নিয়ম। এতে অনেক সময় অপচয় হয়, কিছুই করার নেই আমাদের।
পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তিনি তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে প্রাক-সমীক্ষা বন্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। তার যুক্তি ছিল, কূপ খনন করলে গ্যাস পেতেও পারি, আবার নাও পেতে পারি। গ্যাস পেলে অনেক মুনাফা, আর না পেলে পুরো বিনিয়োগ জিরো, এখানে আবার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের অর্থ কী? এটাতো ব্রিজ-কালভার্ট নয় যে সম্ভাব্যতা যাচাই করবো। এখান থেকে রিটার্ণ আসতে পারে, আবার না আসতে পারে। আমরা যখন কূপ খননের জায়গা চুড়ান্ত করি তার আগে সিসমিক সার্ভেসহ অনেক কাজ করতে হয়, এটাওতো এক ধরণের ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি। তাহলে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে কেনো সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর বিষয়টি নাকচ হয়ে যায়। এখন তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে প্রাক-সমীক্ষাতেও অনেক সময় লেগে যায়।
বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদ নিয়ে নানা রাজনীতি বিদ্যমান। এক সময় বলা হলো গ্যাসের উপর দেশ ভাসছে, আবার আরেক সময় বলা হলো গ্যাস নেই আমদানি করতে হবে। এই রাজনৈতিক খেলার কারণে অনুসন্ধান কার্যক্রম এখনও তিমিরেই বলা চলে। বাংলাদেশের ভূ-খন্ডে প্রথম কূপ খনন করা হয় ১৯১১ সালে। ১১৪ বছরে অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে কমবেশি ১০০টি। আন্তর্জাতিকভাবে ১০টি কূপ খনন করে একটিতে গ্যাস পাওয়া গেলে সফল বলা হয়। সেখানে বাংলাদেশের ১০০টি অনুসন্ধান কূপ খনন করে ২৯ গ্যাস ফিল্ড আবিস্কৃত হয়েছে। অর্থাৎ সাফল্যের হার তিন অনুপাত এক।
১৯৯৫ সালের জ্বালানি নীতিমালায় বছরে ৪টি অনুসন্ধান কূপ খনন করার কথা বলা হয়। কিন্তু কোন সরকারেই সেই লক্ষ্যমাত্রার ধারের কাছেও ঘেষতে পারেনি। যে কারণে আজকের এই মহাসংকট বলে অনেকেই মনে করেন।