গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশ বাড়ানোর তোড়জোড়, আকাশচুম্বী হয়ে পড়তে পারে ইউরিয়া সারের দাম। একদিকে কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাবের শঙ্কা, তেমনি দেশীয় সার কারখানার জন্যও হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
সর্বশেষ ২০২২ সালের জুন মাসে গ্যাসের দাম ৪ দশমিক ৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা করা হয়। এবার সেই ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০টাকা করার প্রস্তাব করেছে পেট্রোবাংলা। যে প্রস্তাব ইতোমধ্যেই আমলে নিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আগামী ৬ অক্টো্বর গণশুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআরসি) চেয়ারম্যান মো. ফজলুর রহমান বলেছেন, দাম বাড়লে যে ট্রেড গ্যাপ (উৎপাদন ও বিক্রয়মূল্যে ঘাটতি) হবে সেই টাকা সরকার দেবে। এখন ৩৮ টাকার মতো খরচ পড়ে আমরা ২৫ টাকা দরে বিক্রি করি, সরকার ১৩ টাকা হারে ভর্তুকি দিচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, তবে ৪০ টাকা দাম হবে না, দাম হয়তো ২৯ অথবা ৩০ টাকার মতো হবে। ৩০ টাকা করা হলে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের উৎপাদন খরচ পড়বে ৪৬ টাকার মতো। তাতে ট্রেড গ্যাপ দাঁড়াবে ২১ টাকার মতো। আর ৪০ টাকা করা হলে দাম পড়বে প্রায় ৫৬ টাকার মতো। তবে বিষয়টি নির্ভর করবে কি পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে তার উপর। গ্যাস সরবরাহ বাড়লে উৎপাদন খরচ কমে আসবে।
চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কোম্পানি অতিরিক্ত প্রধান হিসাবরক্ষক ও বিভাগীয় প্রধান (হিসাব ও অর্থ বিভাগ) মো. মোবারক হোসেন বলেছেন, গ্যাসের দাম ৪০ টাকা করা হলে টন প্রতি ইউরিয়া উৎপাদনের খরচ ১ লাখ টাকা গিয়ে ঠেকবে। গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় আর যদি সারের দাম না বাড়ে তাহলে প্রতি টনে ৬৫ হাজার টাকার মতো ঘাটতি হবে। বর্তমান আমরা বিক্রি করছি ২৫ হাজার টাকা দরে, আর সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে ১৩ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, গ্যাস সরবরাহ না থাকাসহ নানা কারণে উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। এতে করে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। দৈনিক ১২০০ টন সার উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে মাত্র ১ লাখ টনের মতো।
অর্থাৎ মাত্র ৩ মাসের মতো উৎপাদনে ছিল, আর ৯ মাস বেকার বসে থেকে সার কারখানাটি। এতে করে অপরেশনার খরচ বেড়ে সার উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে।
বিইআরসি ২০২২ সালের ৬ জুন গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আদেশে সবাইকে অবাক করে সার উৎপাদনে প্রতি ঘনমিটার ৪ দশমিক ৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা নির্ধারণ করে। আর তারপর শুরু হয় রশি টানাটানি। সরকারি সার কারখানাগুলো এই আদেশ মানতে অপারগতা প্রকাশ করে, অনেক দেন দরবার শেষে কয়েক মাস আগে নতুন দর মেনে নিয়েছে কারখানাগুলো।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছে, ১ ঘনমিটার গ্যাস দিয়ে (থামরুল) ২ দশমিক ২ থেকে ২ দশমিক ৮ কেজি সার উৎপাদন করা সম্ভব। এরসঙ্গে রয়েছে অপরেশনাল ব্যয়সহ অন্যান্য খরচ। শিল্প মন্ত্রণালয়ে হিসাব অনুযায়ী যখন প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৪ দশমিক ৪৫ টাকা ছিল তখন প্রতি কেজি ইউরিয়া সার উৎপাদনের খরচ পড়তো ১৯ টাকার মতো। এরপর ১১ দশমিক ৫৫ টাকা বাড়িয়ে ১৬ টাকা করা হলে খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ টাকার মতো।
বর্তমানে প্রতিকেজি ইউরিয়া সার ডিলার পর্যায়ে ২৫ টাকা দরে এবং গ্রাহক পর্যায়ে ২৭ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। ২০২৩ সালের ১০ এপ্রিল নতুন দর নির্ধারণ করা হয়। তার আগে কেজি প্রতি ইউরিয়া সারের দাম ছিল ২০ টাকা।
পেট্রোবাংলা বলেছেন, দাম বাড়ানো হলে ৬ মাস (অক্টোবর-মার্চ) পুরোমাত্রায় (২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হবে। অবশিষ্ট ৬ মাসের মধ্যে এপ্রিল-মে ১৬৫ মিলিয়ন হারে, জুনে ১৭৫ মিলিয়ন এবং জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৩০ মিলিয়ন হারে গ্যাস সরবরাহ দেবে। বর্তমানে সার উৎপাদনে দৈনিক ৬৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে।
সারের উৎপাদন খরচ কত বৃদ্ধি পাবে, তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব কি হবে। সে বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি পেট্রোবাংলার প্রস্তাবে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজানুর রহমান বলেছেন, শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিআইসির সঙ্গে বৈঠক হয়েছে, তারা গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়ে একমত হয়েছেন। বাড়তি টাকা দিয়ে আরও বেশি এলএনজি আমদানি করে সার উৎপাদনে দেওয়া হবে। তাতে করে গ্যাস অভাবে বন্ধ ৪টি সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত হবে। দাম বাড়ালেও গ্যাস সরবরাহ বেশি পেলে আমদানির চেয়ে খরচ কম পড়বে।
ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেছেন, কৃষি, জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তার বারোটা বাজানোর জন্য এসব করা হচ্ছে। এতে করে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মূখে পড়বে। সর্বনাশের চূড়ান্ত পর্য ায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংক এবং আইএমএফ কৃষিকে বাণিজ্যিকিকরণ করতে চায়। দুঃখজনক হচ্ছে আগের সরকার যে পথে হেটেছে, এই সরকারও সেই পথেই হাটছে।
বিসিআইসির তথ্য অনুযায়ী ট্রেড গ্যাপ ভর্তুকি আকারে দেওয়া হবে। তাহলে সেই ভর্তুকি এনার্জি খাতে যুক্ত করলেই সবচেয়ে উপযুক্ত সমাধান হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। উল্টো সারের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিলে জটিল পরিস্থিতির শঙ্কা দেখছেন তারা।
বাংলাদেশে বছরে সারের মোট চাহিদা হতে পারে প্রায় ৬৯ লাখ টনের মতো। আর চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে। দেশে ৬টি সার কারখানা রয়েছে। এরমধ্যে ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত আশুগঞ্জ সার কারখানা অনেক পুরনো হওয়ায় গ্যাস খরচ অনেক বেশি, যে কারণে কারখানাটি বন্ধ রাখা হয়েছে। অপর ৫টি সার কারখানায় দৈনিক গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট।