৬৬ বছরের জীবন ছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। এই পৃথিবী থেকে তাঁর দেহ বিলীন হয়েছে তাও ১৩০ বছর আগে। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়সে ২৩ বছরের বড় ছিলেন তিনি। মৃত্যুর এত বছর পরও বাঙালি ভুলতে পারেনি তার প্রথম স্নাতক বঙ্কিমকে। বঙ্কিমচন্দ্র পেশায় ছিলেন ব্রিটিশরাজের পদস্থ কর্মকর্তা। কিন্তু মানুষ এ জন্য তাঁকে মনে রাখেনি। এতকাল বাদেও মানুষ তাঁকে ভুলতে পারেনি তার কারণ, যে কথাসাহিত্য তিনি সৃষ্টি করে গেছেন, তা এখনো সাহিত্যপ্রেমী মানুষের মনোজগতে রয়ে গেছে বিপুলভাবে। ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘মৃণালিনী’, ‘বিষবৃক্ষ’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘আনন্দমঠ’, ‘দেবী চৌধুরানী’র মতো উপন্যাসের বাইরেও প্রচুর প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও গল্প লিখেছেন তিনি। তবে নাম করেছেন উপন্যাস লিখে, বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ সব চরিত্র সৃষ্টি করে। ‘সাহিত্য সম্রাট’ উপাধি তো আর এমনি এমনি জোটেনি। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত অতি প্রাচীন সাহিত্য পত্রিকা বঙ্গদর্শনেরও সম্পাদক ছিলেন তিনি। সরকারি চাকরির পাশাপাশি এই পত্রিকার কাজ নিজ হাতে করতেন বঙ্কিমবাবু। এ নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। লেখকের স্ত্রী পত্রিকার প্রচ্ছদে ‘ব’ এর নিচে একটি ফোঁটা বসিয়ে ফেলেন। বঙ্কিম সেদিন পত্রিকাটির দ্বিতীয় ভাগ পড়ছিলেন। মেয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, তুমি বলেছিল পত্রিকাটির নাম বঙ্গদর্শন। কিন্তু এ যে রঙ্গদর্শন!’ বঙ্কিম বিষয়টি বেশ বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘আমি তো বঙ্গদর্শনই লিখেছিলাম। তোমার গর্ভধারিণীর গুণে রঙ্গদর্শন হয়েছে। আমি কী করব মা!
বঙ্কিমচন্দ্রের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে। এটা ঠিক যে বন্দে মাতরমের এই স্রষ্টা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের কট্টর সমর্থক ছিলেন। এটা দোষের নয়। বিষয় হলো, সেই জাতীয়তাবাদী চেতনা দেশের সব ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়কে স্পর্শ করছে কি না। সবাইকে এক কাতারে শামিল করছে কি না।
আজ ২৬ জুন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন। আজ থেকে ১৮৬ বছর আগে যখন বঙ্কিম পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন, তখন ভূভারত শাসন করত ব্রিটিশরাজ। তখন এ অঞ্চলে একটাই দেশ ছিল, যার নাম ছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া। সেই ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার বাংলা অঞ্চলে, উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরের কাছে কাঁঠালপাড়া (কারও কারও মতে কাঁটালপাড়া) গ্রামে বঙ্কিমের জন্ম। বঙ্কিমের বাবা যাদবচন্দ্রও ব্রিটিশ সরকারের চাকুরে ছিলেন। তাঁদের পরিবার ছিল বেশ শিক্ষিত।
ছোটবেলা থেকেই প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তবে তিনি নিয়মিত পড়াশোনা করতেন, এমন নয়। পরীক্ষা এলেই কেবল বইয়ের খোঁজ পড়ত। শোনা যায়, একবসায়ই একটি বই পড়ে শেষ করতে পারতেন তিনি। তবে বঙ্কিম লেখাপড়ায় বেশি ভালো হলেও তাঁর দাদারা ততটা ভালো ছিলেন না। এক দাদা তো সারাক্ষণ তাসের ওপর থাকতেন। গাঁজা, চরস খেয়ে নেশায় চুর হয়ে থাকতেন। সেসব দেখে বঙ্কিমেরও ছোটবেলায় একটু-আধটু গাঁজা খাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। তবে গাঁজার নেশায় তিনি কখনো নিজেকে হারিয়ে ফেলেননি।
আজ জন্মদিনে আমরা বঙ্কিমকে নিয়ে কিছুটা আলোচনা করব। তাঁর সাহিত্যজগতে নয়, আলো ফেলব তাঁর জীবন, প্রেম ও ভালোবাসার সীমানায়।