ঢাকা ০২:২৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫, ২৫ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইসরায়েলের নজর কি এবার আফ্রিকায়?

গাজায় সামরিক অভিযানের কারণে যখন বিশ্বজুড়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে তেলআবিব, তখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে নতুন দিক খুঁজছে ইসরায়েল। সেই লক্ষ্যেই আফ্রিকার দিকে নতুন করে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে ইসরায়েল। পুরোনো সম্পর্ক ঝালিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি নতুন মিত্র খোঁজার প্রচেষ্টা চলছে স্পষ্টভাবে।

সম্প্রতি জাম্বিয়ায় দীর্ঘ ৫২ বছর পর ইসরায়েলি দূতাবাস পুনরায় চালু হয়েছে। এই ঘটনা শুধু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নয়, বরং আফ্রিকায় ইসরায়েলের নতুন কৌশলগত প্রত্যাবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিত। দূতাবাস উদ্বোধনের সময় ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডন সার বলেন, জাম্বিয়ায় ফিরছে ইসরায়েল, আফ্রিকায় ফিরছে ইসরায়েল।

বিশ্লেষকদের মতে, গাজার যুদ্ধকালে যখন দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগ এনেছে, তখন জাম্বিয়ার মতো দেশকে পাশে টেনে এনে আফ্রিকায় প্রভাবের ভারসাম্য বদলাতে চাইছে ইসরায়েল।

জাম্বিয়ার পর ইসরায়েলি কূটনীতিকদের সফর লক্ষ্য করার মতো। নাইজেরিয়ায় সফর করেছেন ইসরায়েলের ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্যারেন হাসকেল। সফরের কিছুদিন পরই নাইজেরিয়ায় ফিলিস্তিনি কমিউনিটির নেতা রামজি আবু ইব্রাহিমকে আটক করা হয়, যদিও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ স্পষ্ট নয়। এরপর তিনি সফর করেন দক্ষিণ সুদান, যেটি ইসরায়েলের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র। সেখানে মানবিক সংকটে থাকা দেশটির পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

তবে এ সফরের সময়ই ফাঁস হয়, ইসরায়েল ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যে এমন একটি আলোচনার বিষয়, যেখানে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোর করে ওই দেশে স্থানান্তরের পরিকল্পনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, এটি যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

একই ধরনের আলোচনা উঠে এসেছে সোমালিল্যান্ড নিয়েও। গাজার উচ্ছেদকৃত ফিলিস্তিনিদের ওই অঞ্চলে পুনর্বাসনের বিনিময়ে দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। তবে সোমালিল্যান্ডের জনগণ এ ধরনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।

আফ্রিকার সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্কের ইতিহাস দীর্ঘ। ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে অনেক newly-independent আফ্রিকান দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিল ইসরায়েল। তখন তারা নিজেদের জাতিসংঘে প্রভাব বাড়াতে ‘স্বাধীন জাতির বন্ধু’ হিসেবে উপস্থাপন করত।

কিন্তু ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে এই সম্পর্ক ভেঙে পড়ে। যুদ্ধের পর আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এরপর ইসরায়েল কিছু দূতাবাস পুনরায় খুললেও, মোটের ওপর আফ্রিকায় তাদের কূটনৈতিক অবস্থান দুর্বলই ছিল।

তবে এখন আফ্রিকার কিছু দেশ, বিশেষ করে পূর্ব আফ্রিকার ইথিওপিয়া, উগান্ডা, দক্ষিণ সুদান, কেনিয়া ও জাম্বিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে উদ্যোগী ইসরায়েল। ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ইসরায়েলি সাহায্য সংস্থা ‘মাশাভ’ এসব দেশে ৪৫ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা পাঠিয়েছে।

তবে সামরিক ও নজরদারি প্রযুক্তির বাণিজ্যেই ইসরায়েল সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করছে। ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া, রুয়ান্ডা, সাউথ আফ্রিকা ও উগান্ডাসহ একাধিক দেশ ইসরায়েল থেকে অস্ত্র কিনেছে। গাজার আগ্রাসনের সমালোচনা করলেও, এসব দেশের সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে এইসব চুক্তি চালিয়ে যাচ্ছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইসরায়েল আফ্রিকার কিছু দুর্বল দেশের আর্থিক সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কাজে লাগাচ্ছে। যেমন জাম্বিয়া ২০২০ সালে বৈদেশিক ঋণ খেলাপি হয়। এখন দেশটি বিনিয়োগের জন্য মরিয়া। এই প্রেক্ষাপটেই ইসরায়েল সেখানে দূতাবাস চালু করে কৌশলগত জয় দাবি করছে।

তবে এই প্রক্রিয়াকে অনেকেই দেখছেন আফ্রিকায় বিভাজন তৈরির চেষ্টা হিসেবে। ইসরায়েল যেখানে একদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো গণহত্যার অভিযোগকারীদের মোকাবিলা করছে, অন্যদিকে জাম্বিয়া ও দক্ষিণ সুদানের মতো দুর্বল দেশগুলোকে পাশে টানছে।

গাজা যুদ্ধ শুরুর পর আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশ ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নিলেও, জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত প্রথম প্রস্তাবে জাম্বিয়া ও দক্ষিণ সুদানসহ ছয়টি আফ্রিকান দেশ ভোটদান থেকে বিরত থাকে। বিষয়টি ইসরায়েলের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার একটি প্রতিচ্ছবি বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা।

জোহানেসবার্গভিত্তিক সংহতি গোষ্ঠী ‘আফ্রিকা ফর ফিলিস্তিন’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ দেসাই মনে করেন, এই কৌশল বাস্তবায়নে ইসরায়েল সফল হবে না। কারণ আফ্রিকার জনগণের মধ্যে ফিলিস্তিনের পক্ষে সমর্থন বাড়ছে।

তিনি বলেন, সরকারের সমর্থন পেলেও, সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ একদিন তাদের থামিয়ে দেবে।

আফ্রিকার বিশ্লেষক রেনেভা ফুরিও বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে যেসব আফ্রিকান দেশ সম্পর্ক জোরদার করছে, তারা মানবিকতা নয়, বরং সামরিক সহায়তা ও বিনিয়োগের প্রলোভনে আগ্রহী।

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

ইসরায়েলের কারাগার থেকে মুক্ত

ইসরায়েলের নজর কি এবার আফ্রিকায়?

আপডেট সময় : ০৩:৪৭:২৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৫

গাজায় সামরিক অভিযানের কারণে যখন বিশ্বজুড়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে তেলআবিব, তখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে নতুন দিক খুঁজছে ইসরায়েল। সেই লক্ষ্যেই আফ্রিকার দিকে নতুন করে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে ইসরায়েল। পুরোনো সম্পর্ক ঝালিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি নতুন মিত্র খোঁজার প্রচেষ্টা চলছে স্পষ্টভাবে।

সম্প্রতি জাম্বিয়ায় দীর্ঘ ৫২ বছর পর ইসরায়েলি দূতাবাস পুনরায় চালু হয়েছে। এই ঘটনা শুধু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নয়, বরং আফ্রিকায় ইসরায়েলের নতুন কৌশলগত প্রত্যাবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিত। দূতাবাস উদ্বোধনের সময় ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডন সার বলেন, জাম্বিয়ায় ফিরছে ইসরায়েল, আফ্রিকায় ফিরছে ইসরায়েল।

বিশ্লেষকদের মতে, গাজার যুদ্ধকালে যখন দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগ এনেছে, তখন জাম্বিয়ার মতো দেশকে পাশে টেনে এনে আফ্রিকায় প্রভাবের ভারসাম্য বদলাতে চাইছে ইসরায়েল।

জাম্বিয়ার পর ইসরায়েলি কূটনীতিকদের সফর লক্ষ্য করার মতো। নাইজেরিয়ায় সফর করেছেন ইসরায়েলের ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্যারেন হাসকেল। সফরের কিছুদিন পরই নাইজেরিয়ায় ফিলিস্তিনি কমিউনিটির নেতা রামজি আবু ইব্রাহিমকে আটক করা হয়, যদিও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ স্পষ্ট নয়। এরপর তিনি সফর করেন দক্ষিণ সুদান, যেটি ইসরায়েলের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র। সেখানে মানবিক সংকটে থাকা দেশটির পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

তবে এ সফরের সময়ই ফাঁস হয়, ইসরায়েল ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যে এমন একটি আলোচনার বিষয়, যেখানে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোর করে ওই দেশে স্থানান্তরের পরিকল্পনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, এটি যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

একই ধরনের আলোচনা উঠে এসেছে সোমালিল্যান্ড নিয়েও। গাজার উচ্ছেদকৃত ফিলিস্তিনিদের ওই অঞ্চলে পুনর্বাসনের বিনিময়ে দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। তবে সোমালিল্যান্ডের জনগণ এ ধরনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।

আফ্রিকার সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্কের ইতিহাস দীর্ঘ। ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে অনেক newly-independent আফ্রিকান দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিল ইসরায়েল। তখন তারা নিজেদের জাতিসংঘে প্রভাব বাড়াতে ‘স্বাধীন জাতির বন্ধু’ হিসেবে উপস্থাপন করত।

কিন্তু ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে এই সম্পর্ক ভেঙে পড়ে। যুদ্ধের পর আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এরপর ইসরায়েল কিছু দূতাবাস পুনরায় খুললেও, মোটের ওপর আফ্রিকায় তাদের কূটনৈতিক অবস্থান দুর্বলই ছিল।

তবে এখন আফ্রিকার কিছু দেশ, বিশেষ করে পূর্ব আফ্রিকার ইথিওপিয়া, উগান্ডা, দক্ষিণ সুদান, কেনিয়া ও জাম্বিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে উদ্যোগী ইসরায়েল। ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ইসরায়েলি সাহায্য সংস্থা ‘মাশাভ’ এসব দেশে ৪৫ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা পাঠিয়েছে।

তবে সামরিক ও নজরদারি প্রযুক্তির বাণিজ্যেই ইসরায়েল সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করছে। ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া, রুয়ান্ডা, সাউথ আফ্রিকা ও উগান্ডাসহ একাধিক দেশ ইসরায়েল থেকে অস্ত্র কিনেছে। গাজার আগ্রাসনের সমালোচনা করলেও, এসব দেশের সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে এইসব চুক্তি চালিয়ে যাচ্ছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইসরায়েল আফ্রিকার কিছু দুর্বল দেশের আর্থিক সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কাজে লাগাচ্ছে। যেমন জাম্বিয়া ২০২০ সালে বৈদেশিক ঋণ খেলাপি হয়। এখন দেশটি বিনিয়োগের জন্য মরিয়া। এই প্রেক্ষাপটেই ইসরায়েল সেখানে দূতাবাস চালু করে কৌশলগত জয় দাবি করছে।

তবে এই প্রক্রিয়াকে অনেকেই দেখছেন আফ্রিকায় বিভাজন তৈরির চেষ্টা হিসেবে। ইসরায়েল যেখানে একদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো গণহত্যার অভিযোগকারীদের মোকাবিলা করছে, অন্যদিকে জাম্বিয়া ও দক্ষিণ সুদানের মতো দুর্বল দেশগুলোকে পাশে টানছে।

গাজা যুদ্ধ শুরুর পর আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশ ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নিলেও, জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত প্রথম প্রস্তাবে জাম্বিয়া ও দক্ষিণ সুদানসহ ছয়টি আফ্রিকান দেশ ভোটদান থেকে বিরত থাকে। বিষয়টি ইসরায়েলের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার একটি প্রতিচ্ছবি বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা।

জোহানেসবার্গভিত্তিক সংহতি গোষ্ঠী ‘আফ্রিকা ফর ফিলিস্তিন’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ দেসাই মনে করেন, এই কৌশল বাস্তবায়নে ইসরায়েল সফল হবে না। কারণ আফ্রিকার জনগণের মধ্যে ফিলিস্তিনের পক্ষে সমর্থন বাড়ছে।

তিনি বলেন, সরকারের সমর্থন পেলেও, সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ একদিন তাদের থামিয়ে দেবে।

আফ্রিকার বিশ্লেষক রেনেভা ফুরিও বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে যেসব আফ্রিকান দেশ সম্পর্ক জোরদার করছে, তারা মানবিকতা নয়, বরং সামরিক সহায়তা ও বিনিয়োগের প্রলোভনে আগ্রহী।