ঢাকা ১২:০২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫, ২৫ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শিক্ষকের মৃত্যুর পর বিদ্যালয় ছেড়ে দেয় দেড়শ শিক্ষার্থী

  • চেতনায়২৪ ডেস্ক :
  • আপডেট সময় : ০৬:৩৫:৪২ অপরাহ্ন, রবিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৫
  • ২২৫ বার পড়া হয়েছে

নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা সদর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে, নাটোর ও পাবনা জেলার সীমান্তবর্তী অঞ্চল রাজাপুর। ১৯৫৬ সালে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজাপুর উচ্চ বিদ্যালয়। দীর্ঘদিন ধরে অনিয়মিত ক্লাস আর ভগ্নপ্রায় ভবনের বোঝা বইতে থাকা এই প্রতিষ্ঠান ধুঁকছিল অবহেলায়। এমন পরিস্থিতিতে পিছিয়ে থাকা সেই বিদ্যালয়ের হাল ধরেন প্রধান শিক্ষক আব্দুল কাদের খান। দায়িত্ব নিয়ে অল্প সময়েই তিনি বিদ্যালয়ের রূপ যেমন বদলে দেন, তেমনি গড়ে তোলেন এক প্রজন্মের মেধাবী ভবিষ্যৎ।

২০০৩ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন আব্দুল কাদের খান। যোগদানের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় তার নতুন যাত্রা। সকাল ৯টায় ক্লাস শুরু হলেও ফজরের নামাজ পড়ে তিনি ভোরেই পৌঁছে যেতেন বিদ্যালয়ে। ছুটি হওয়ার পরও স্কুলে থেকে যেতেন। রাতের আঁধারে শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়াশোনার খোঁজ নিতেন। অভিভাবকদের দিতেন পরামর্শ, শিক্ষার্থীদের দিতেন প্রশ্নের সমাধান। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের আস্থার কেন্দ্রবিন্দু। পরিচিতি পান ‘আব্দুল কাদের বিএসসি’ নামে।

শিক্ষক আব্দুল কাদের খানকে ঘিরে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সাবেক শিক্ষার্থী শামসুল আলম রনি, সজিব আহমেদ, বিপ্লব হোসেনসহ অনেকে জানান, বিদ্যালয়ের প্রতি মহান এই শিক্ষকের শাসন, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর আত্মত্যাগের কথা আজও তারা স্মরণ করেন।

সাবেক শিক্ষার্থী শামছুল আলম রনি বলেন, একমাত্র কাদের স্যারকে দেখেছি, যিনি বেলা ওঠার আগেই স্কুলে চলে আসতেন। আবার স্কুল ছুটির পর তিনি স্কুলেই থেকে যেতেন। বাজারে ঘুরে দেখতেন, কোনো শিক্ষার্থী কোথাও আড্ডা দিচ্ছে কিনা। সন্ধ্যার পর তিনি শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনার খবর নিতেন। একজন আদর্শ শিক্ষকের সবটুকু গুণই আব্দুল কাদের স্যারের মধ্যে ছিল।

দুর্বল শিক্ষার্থীদের ভালো ফলাফল করাতে উদ্যোগ নেন শিক্ষক আব্দুল কাদের। টেস্ট পরীক্ষার ফলাফল দেখে শিক্ষার্থীদের ভাগ করে বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগের চমক দেখা দেয়। ২০০৭ সালে জেএসসি পরীক্ষায় রাজাপুরের প্রথম শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়। ২০০৮ সালে এসএসসিতে একসঙ্গে ৩৩ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ অর্জন করে আলোড়ন তোলে। ২০১২ সালে এসএসসিতে শতভাগ পাশের পাশাপাশি একসঙ্গে ৮৮ জনের জিপিএ-৫ পাওয়া ছিল নতুন রেকর্ড। ২০১৩ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত পাশের হার ৯৯ শতাংশে স্থায়ী হয়ে যায়। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে থাকে। শিক্ষার্থী সংখ্যা ২ হাজার জন ছাড়িয়ে যায়। রাজাপুর উচ্চ বিদ্যালয় হয়ে ওঠে জেলার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। আর ২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবেই জেলার সেরা বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পায় রাজাপুর উচ্চ বিদ্যালয়।

তবে আব্দুল কাদের খানের এই স্বপ্নযাত্রা বেশিদিন দীর্ঘ হয়নি। ২০১৭ সালের ৩ অক্টোবর লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই শিক্ষার্থীসহ শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে রাজাপুর, দাশুড়িয়া, বনপাড়াসহ আশপাশের গ্রামের মানুষ। তার মৃত্যুর এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় দেড়শ শিক্ষার্থী বিদ্যালয় ছেড়ে চলে যায় অন্য প্রতিষ্ঠানে। ফলাফলেও নেমে আসে পতনের ছায়া। ২০১৮ সালে পাশের হার নেমে আসে ৯৪ শতাংশে, ২০১৯ সালে পাশের হার দাঁড়ায় ৯৩ শতাংশে। সর্বশেষ ২০২৪ সালে ৩৩৩ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে মাত্র ১৫ জন।

বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক এবিএম আশরাফুল ইসলাম বলেন, কাদের স্যার জাদুকরী কিছু কার্যক্রম চালাতেন। তার একান্ত এসব বৈশিষ্ট অল্প সময়ের মধ্যেই বিদ্যালয়কে একটি গর্বিত স্থানে পৌঁছে দেয়। এমনও হয়েছে মাঝ রাত পর্যন্ত তিনি শিক্ষার্থীদের বাড়িতে বাড়িতে ঘুরেছেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি স্কুলের ভবন ও সীমানা প্রাচীর—এসব তার উদ্যোগেই নির্মিত হয়েছে। একজন আদর্শ শিক্ষকের সব গুণাবলিই কাদের স্যারের ছিল।

ব্যক্তি জীবনে দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক হলেও শিক্ষক কাদের খানের কাছে স্কুলই ছিল আসল পরিবার।

তার বড় ছেলে মোস্তফা কামাল বলেন, আমার বাবা অবসময় স্কুলকেই পরিবারের চেয়ে বেশি কিছু মনে করতেন। তার চিন্তা-চেতনাজুড়ে ছিল শুধুই স্কুল। কোনো কোনো দিন শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে রাতে স্কুলে নাইট গার্ডের রুমেই বাবা শুয়ে থাকতেন। রাজাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ইট-পাথরে এখনো বাবার শ্রম, ঘাম আর স্বপ্ন মিশে আছে। এমন বাবার সন্তান হতে পেরে আমরা সত্যিই গর্বিত।

আব্দুল কাদের খান দেখিয়েছেন একজন নিবেদিতপ্রাণ প্রধান শিক্ষক কীভাবে বদলে দিতে পারেন একটি স্কুলের ভাগ্য, একটি অঞ্চলের ভবিষ্যৎ। এই মহান শিক্ষকের রেখে যাওয়া শিক্ষা, শৃঙ্খলা আর ভালোবাসা নতুন প্রজন্মকে এখনও পথ দেখায়।

ট্যাগস :
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

ইসরায়েলের কারাগার থেকে মুক্ত

শিক্ষকের মৃত্যুর পর বিদ্যালয় ছেড়ে দেয় দেড়শ শিক্ষার্থী

আপডেট সময় : ০৬:৩৫:৪২ অপরাহ্ন, রবিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৫

নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা সদর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে, নাটোর ও পাবনা জেলার সীমান্তবর্তী অঞ্চল রাজাপুর। ১৯৫৬ সালে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজাপুর উচ্চ বিদ্যালয়। দীর্ঘদিন ধরে অনিয়মিত ক্লাস আর ভগ্নপ্রায় ভবনের বোঝা বইতে থাকা এই প্রতিষ্ঠান ধুঁকছিল অবহেলায়। এমন পরিস্থিতিতে পিছিয়ে থাকা সেই বিদ্যালয়ের হাল ধরেন প্রধান শিক্ষক আব্দুল কাদের খান। দায়িত্ব নিয়ে অল্প সময়েই তিনি বিদ্যালয়ের রূপ যেমন বদলে দেন, তেমনি গড়ে তোলেন এক প্রজন্মের মেধাবী ভবিষ্যৎ।

২০০৩ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন আব্দুল কাদের খান। যোগদানের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় তার নতুন যাত্রা। সকাল ৯টায় ক্লাস শুরু হলেও ফজরের নামাজ পড়ে তিনি ভোরেই পৌঁছে যেতেন বিদ্যালয়ে। ছুটি হওয়ার পরও স্কুলে থেকে যেতেন। রাতের আঁধারে শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়াশোনার খোঁজ নিতেন। অভিভাবকদের দিতেন পরামর্শ, শিক্ষার্থীদের দিতেন প্রশ্নের সমাধান। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের আস্থার কেন্দ্রবিন্দু। পরিচিতি পান ‘আব্দুল কাদের বিএসসি’ নামে।

শিক্ষক আব্দুল কাদের খানকে ঘিরে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সাবেক শিক্ষার্থী শামসুল আলম রনি, সজিব আহমেদ, বিপ্লব হোসেনসহ অনেকে জানান, বিদ্যালয়ের প্রতি মহান এই শিক্ষকের শাসন, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর আত্মত্যাগের কথা আজও তারা স্মরণ করেন।

সাবেক শিক্ষার্থী শামছুল আলম রনি বলেন, একমাত্র কাদের স্যারকে দেখেছি, যিনি বেলা ওঠার আগেই স্কুলে চলে আসতেন। আবার স্কুল ছুটির পর তিনি স্কুলেই থেকে যেতেন। বাজারে ঘুরে দেখতেন, কোনো শিক্ষার্থী কোথাও আড্ডা দিচ্ছে কিনা। সন্ধ্যার পর তিনি শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনার খবর নিতেন। একজন আদর্শ শিক্ষকের সবটুকু গুণই আব্দুল কাদের স্যারের মধ্যে ছিল।

দুর্বল শিক্ষার্থীদের ভালো ফলাফল করাতে উদ্যোগ নেন শিক্ষক আব্দুল কাদের। টেস্ট পরীক্ষার ফলাফল দেখে শিক্ষার্থীদের ভাগ করে বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগের চমক দেখা দেয়। ২০০৭ সালে জেএসসি পরীক্ষায় রাজাপুরের প্রথম শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়। ২০০৮ সালে এসএসসিতে একসঙ্গে ৩৩ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ অর্জন করে আলোড়ন তোলে। ২০১২ সালে এসএসসিতে শতভাগ পাশের পাশাপাশি একসঙ্গে ৮৮ জনের জিপিএ-৫ পাওয়া ছিল নতুন রেকর্ড। ২০১৩ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত পাশের হার ৯৯ শতাংশে স্থায়ী হয়ে যায়। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে থাকে। শিক্ষার্থী সংখ্যা ২ হাজার জন ছাড়িয়ে যায়। রাজাপুর উচ্চ বিদ্যালয় হয়ে ওঠে জেলার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। আর ২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবেই জেলার সেরা বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পায় রাজাপুর উচ্চ বিদ্যালয়।

তবে আব্দুল কাদের খানের এই স্বপ্নযাত্রা বেশিদিন দীর্ঘ হয়নি। ২০১৭ সালের ৩ অক্টোবর লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই শিক্ষার্থীসহ শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে রাজাপুর, দাশুড়িয়া, বনপাড়াসহ আশপাশের গ্রামের মানুষ। তার মৃত্যুর এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় দেড়শ শিক্ষার্থী বিদ্যালয় ছেড়ে চলে যায় অন্য প্রতিষ্ঠানে। ফলাফলেও নেমে আসে পতনের ছায়া। ২০১৮ সালে পাশের হার নেমে আসে ৯৪ শতাংশে, ২০১৯ সালে পাশের হার দাঁড়ায় ৯৩ শতাংশে। সর্বশেষ ২০২৪ সালে ৩৩৩ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে মাত্র ১৫ জন।

বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক এবিএম আশরাফুল ইসলাম বলেন, কাদের স্যার জাদুকরী কিছু কার্যক্রম চালাতেন। তার একান্ত এসব বৈশিষ্ট অল্প সময়ের মধ্যেই বিদ্যালয়কে একটি গর্বিত স্থানে পৌঁছে দেয়। এমনও হয়েছে মাঝ রাত পর্যন্ত তিনি শিক্ষার্থীদের বাড়িতে বাড়িতে ঘুরেছেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি স্কুলের ভবন ও সীমানা প্রাচীর—এসব তার উদ্যোগেই নির্মিত হয়েছে। একজন আদর্শ শিক্ষকের সব গুণাবলিই কাদের স্যারের ছিল।

ব্যক্তি জীবনে দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক হলেও শিক্ষক কাদের খানের কাছে স্কুলই ছিল আসল পরিবার।

তার বড় ছেলে মোস্তফা কামাল বলেন, আমার বাবা অবসময় স্কুলকেই পরিবারের চেয়ে বেশি কিছু মনে করতেন। তার চিন্তা-চেতনাজুড়ে ছিল শুধুই স্কুল। কোনো কোনো দিন শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে রাতে স্কুলে নাইট গার্ডের রুমেই বাবা শুয়ে থাকতেন। রাজাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ইট-পাথরে এখনো বাবার শ্রম, ঘাম আর স্বপ্ন মিশে আছে। এমন বাবার সন্তান হতে পেরে আমরা সত্যিই গর্বিত।

আব্দুল কাদের খান দেখিয়েছেন একজন নিবেদিতপ্রাণ প্রধান শিক্ষক কীভাবে বদলে দিতে পারেন একটি স্কুলের ভাগ্য, একটি অঞ্চলের ভবিষ্যৎ। এই মহান শিক্ষকের রেখে যাওয়া শিক্ষা, শৃঙ্খলা আর ভালোবাসা নতুন প্রজন্মকে এখনও পথ দেখায়।