ঢাকা ১২:০০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫, ২৫ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেল ফুলবাড়িয়ার লাল চিনি

  • চেতনায়২৪ ডেস্ক :
  • আপডেট সময় : ১১:৫০:০৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৭ অগাস্ট ২০২৫
  • ২২৮ বার পড়া হয়েছে

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় আখের রস থেকে হাতে তৈরি লাল পাউডার চিনির ঐতিহ্য প্রায় আড়াইশ’ বছরের। মিহি দানার এ চিনি শরবত, পিঠা বা মিষ্টান্ন সব কিছুতেই ব্যবহার করা হয়। এই চিনি তৈরির প্রক্রিয় সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এবং শতভাগ বিশুদ্ধ। 

এটি কেবলমাত্র আখের রস থেকে তৈরি হয়, যা স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। কোনো ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার ছাড়া অর্গানিক এ চিনির কদরও বেশ। এ উপজেলায় উৎপাদিত চিনি প্রতিবছর প্রায় শত কোটি টাকায় বিক্রি হয় বলে জানায় কৃষি বিভাগ। ঐতিহ্যবাহী লাল চিনি ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য স্বীকৃতি পেয়েছে।

বুধবার (২৭ আগস্ট) সকালে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফুলবাড়িয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ।

নূর মোহাম্মদ বলেন, গতকাল মঙ্গলবার ওয়েবসাইট চেক করে আজ আমরা জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি। ২০২৪ সালের ১১ জুলাই ফুলবাড়িয়ার লাল চিনির জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করা হয় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে। আবেদন নম্বর ছিল জিআই-৮৮। গত ২৭ মে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর থেকে জার্নালে প্রকাশ করা হয়। আর কোনো পক্ষের দাবি আছে কী না সে জন্য জার্নালটি প্রকাশ করা হলেও কারো দাবি না থাকায় সব প্রক্রিয়া শেষে আমরা স্বীকৃতি পেয়েছি। সনদের জন্য আজ সরকার নির্ধারিত ফি জমা দিয়েছি।

তিনি আরো বলেন, জিআই স্বীকৃতির মাধ্যমে অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসবে। আগে যারা লাল চিনি সম্পর্কে জানতো না তারাও এখন জানতে পারবে। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় কৃষকেরাও এটির উৎপাদন বাড়াবে এবং সরকারেরও পৃষ্ঠপোষকতা বাড়বে। অর্গানিক পণ্য হিসেবে দেশের বাইরে রপ্তানি করা গেলে চাষিদের জন্য অন্যরকম সুযোগ তৈরি হবে।

কৃষি বিভাগ জানায়, উপজেলার বাকতা, কালাদহ ও রাধাকানাই ইউনিয়নের প্রায় ২০টি গ্রামের কৃষক আখ উৎপাদন ও চিনি তৈরির কাজ করেন।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, লাল চিনি তৈরির একমাত্র কাঁচামাল হলো আখ। আখের রস আগুনে জ্বাল দিয়ে লাল চিনি তৈরি করা হয়। আখ মাড়াইয়ের আগে চাষিরা লাল চিনি তৈরির জন্য জ্বালঘর তৈরি করেন। লাল চিনি তৈরির জন্য প্রথমে আখ জমি থেকে সংগ্রহ করে তা পরিস্কার করে যন্ত্রচালিত আখ মাড়াইকলের সাহায্যে আখ থেকে রস বের করা হয়। জ্বালঘরের চুলায় সাতটি লোহার কড়াই বসানো হয়। তারপর প্রথম কড়াইয়ে পরিমাণ মতো কাঁচা রস দিয়ে জ্বাল দেওয়া শুরু করা হয়।

জ্বাল দেওয়ার আধা ঘণ্টা পর প্রথম কড়াই থেকে দ্বিতীয় কড়াইয়ে, তারপর তৃতীয় কড়াইয়ে এভাবে সপ্তম কড়াইয়ে জ্বাল দেওয়া রস ঘন হলে চুলা থেকে নামিয়ে কাঠের তৈরি মুগুর দিয়ে বারবার ঘর্ষণ করে অ-দানাদার বাদামি রঙের লাল চিনি তৈরি করা হয়।

যতক্ষণ না পাকা রস শুকনো ধুলার মতো হয়ে যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত ঘোটার কাজ থাকে। আখের গুণগত মান খারাপ হলে ধুলার মতো না হয়ে গুটি গুটি আকার ধারণ করে। ধুলার মতো বা গুটির মতো যাই হোক, ফুলবাড়িয়ার ভাষায় এটিই হলো ঐতিহ্যবাহী লাল চিনি। দেখতে ধূসর বাদামি বা হালকা খয়েরি হলেও সাদা চিনির বিপরীতেই হয়তো ‘লাল চিনি’ নামকরণ করা হয় একে। চিনি হওয়ার পর তা রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়।

জমিতে আখ গুলো চৈত্র মাসে লাগানো হয়। আখ মাড়াই শুরু হয় পৌষ মাসের শুরু থেকে। দীর্ঘ এক বছরে একটি ফসল হয়। আড়াই মাস সময়ের মধ্যে এই চিনি তৈরি হয়।

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এ উপজেলাটি একটি বৈচিত্র্যময় উপজেলা। এখানে প্রধান ফসল ধানের পাশাপাশি আখসহ অন্যান্য ফসলও হয়। আখ থেকে বিশেষ এক ধরনের পণ্য তৈরি হয়, যাকে বলা হয় লাল চিনি।

২০২৫ সালে ৬৫০ হেক্টর জমিতে আখ হয়। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ জমিতে দেশী জাতের আখের আবাদ হয়। বাকি জমিতে ঈশ্বরদী-৪১ ও ঈশ্বরদী-৪২ জাতের আখ হয়। এক হেক্টর জমি থেকে প্রায় ৮ মেট্রিকটন লাল চিনি উৎপাদন হয়। লাল চিনি গড়ে ৮ হাজার টাকা মণ বিক্রি হয়।

এ বছর প্রায় ১০৮ কোটি টাকা লাল চিনি বিক্রি করে আয় করে কৃষকেরা। এক মেট্রিকটন আখ থেকে প্রায় ৩২ হাজার লিটার রস হয়। চার কেজি রস থেকে এক কেজি লাল চিনি বের হয়।

লাল চিনি সম্পূর্ণ ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে তৈরি হয়। চুলা পরিবর্তনের মাধ্যমে রস গুলো জাল করে, অনবরত হাতের মাধ্যমে ঘূর্ণায়মান করে চিনি উৎপাদন করা হয়। এটি সম্পূর্ণ অর্গানিক বলা যায়। যার কারণে, এটি শরবত বা মিস্টান্ন হিসেবে যখন পান করা হয় তখন কাঁচা রসের ফ্লেভার পাওয়া যায়। ফলে দেশে ও বিদেশেও এর চাহিদা রয়েছে। এ চিনিকে যারা চিনে তারা অনলাইনের মাধ্যমে বিদেশে নিচ্ছে।

ফুলবাড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আরিফুর ইসলাম বলেন, লাল চিনির জিআই স্বীকৃতির বিষয়টি আজ আমরা নিশ্চিত হয়ে সনদের জন্য টাকা জমা দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছি৷ এই স্বীকৃতিতে উচ্ছ্বসিত এ অঞ্চলের মানুষ। এই স্বীকৃতি এ অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

ইসরায়েলের কারাগার থেকে মুক্ত

জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেল ফুলবাড়িয়ার লাল চিনি

আপডেট সময় : ১১:৫০:০৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৭ অগাস্ট ২০২৫

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় আখের রস থেকে হাতে তৈরি লাল পাউডার চিনির ঐতিহ্য প্রায় আড়াইশ’ বছরের। মিহি দানার এ চিনি শরবত, পিঠা বা মিষ্টান্ন সব কিছুতেই ব্যবহার করা হয়। এই চিনি তৈরির প্রক্রিয় সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এবং শতভাগ বিশুদ্ধ। 

এটি কেবলমাত্র আখের রস থেকে তৈরি হয়, যা স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। কোনো ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার ছাড়া অর্গানিক এ চিনির কদরও বেশ। এ উপজেলায় উৎপাদিত চিনি প্রতিবছর প্রায় শত কোটি টাকায় বিক্রি হয় বলে জানায় কৃষি বিভাগ। ঐতিহ্যবাহী লাল চিনি ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য স্বীকৃতি পেয়েছে।

বুধবার (২৭ আগস্ট) সকালে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফুলবাড়িয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ।

নূর মোহাম্মদ বলেন, গতকাল মঙ্গলবার ওয়েবসাইট চেক করে আজ আমরা জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি। ২০২৪ সালের ১১ জুলাই ফুলবাড়িয়ার লাল চিনির জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করা হয় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে। আবেদন নম্বর ছিল জিআই-৮৮। গত ২৭ মে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর থেকে জার্নালে প্রকাশ করা হয়। আর কোনো পক্ষের দাবি আছে কী না সে জন্য জার্নালটি প্রকাশ করা হলেও কারো দাবি না থাকায় সব প্রক্রিয়া শেষে আমরা স্বীকৃতি পেয়েছি। সনদের জন্য আজ সরকার নির্ধারিত ফি জমা দিয়েছি।

তিনি আরো বলেন, জিআই স্বীকৃতির মাধ্যমে অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসবে। আগে যারা লাল চিনি সম্পর্কে জানতো না তারাও এখন জানতে পারবে। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় কৃষকেরাও এটির উৎপাদন বাড়াবে এবং সরকারেরও পৃষ্ঠপোষকতা বাড়বে। অর্গানিক পণ্য হিসেবে দেশের বাইরে রপ্তানি করা গেলে চাষিদের জন্য অন্যরকম সুযোগ তৈরি হবে।

কৃষি বিভাগ জানায়, উপজেলার বাকতা, কালাদহ ও রাধাকানাই ইউনিয়নের প্রায় ২০টি গ্রামের কৃষক আখ উৎপাদন ও চিনি তৈরির কাজ করেন।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, লাল চিনি তৈরির একমাত্র কাঁচামাল হলো আখ। আখের রস আগুনে জ্বাল দিয়ে লাল চিনি তৈরি করা হয়। আখ মাড়াইয়ের আগে চাষিরা লাল চিনি তৈরির জন্য জ্বালঘর তৈরি করেন। লাল চিনি তৈরির জন্য প্রথমে আখ জমি থেকে সংগ্রহ করে তা পরিস্কার করে যন্ত্রচালিত আখ মাড়াইকলের সাহায্যে আখ থেকে রস বের করা হয়। জ্বালঘরের চুলায় সাতটি লোহার কড়াই বসানো হয়। তারপর প্রথম কড়াইয়ে পরিমাণ মতো কাঁচা রস দিয়ে জ্বাল দেওয়া শুরু করা হয়।

জ্বাল দেওয়ার আধা ঘণ্টা পর প্রথম কড়াই থেকে দ্বিতীয় কড়াইয়ে, তারপর তৃতীয় কড়াইয়ে এভাবে সপ্তম কড়াইয়ে জ্বাল দেওয়া রস ঘন হলে চুলা থেকে নামিয়ে কাঠের তৈরি মুগুর দিয়ে বারবার ঘর্ষণ করে অ-দানাদার বাদামি রঙের লাল চিনি তৈরি করা হয়।

যতক্ষণ না পাকা রস শুকনো ধুলার মতো হয়ে যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত ঘোটার কাজ থাকে। আখের গুণগত মান খারাপ হলে ধুলার মতো না হয়ে গুটি গুটি আকার ধারণ করে। ধুলার মতো বা গুটির মতো যাই হোক, ফুলবাড়িয়ার ভাষায় এটিই হলো ঐতিহ্যবাহী লাল চিনি। দেখতে ধূসর বাদামি বা হালকা খয়েরি হলেও সাদা চিনির বিপরীতেই হয়তো ‘লাল চিনি’ নামকরণ করা হয় একে। চিনি হওয়ার পর তা রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়।

জমিতে আখ গুলো চৈত্র মাসে লাগানো হয়। আখ মাড়াই শুরু হয় পৌষ মাসের শুরু থেকে। দীর্ঘ এক বছরে একটি ফসল হয়। আড়াই মাস সময়ের মধ্যে এই চিনি তৈরি হয়।

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এ উপজেলাটি একটি বৈচিত্র্যময় উপজেলা। এখানে প্রধান ফসল ধানের পাশাপাশি আখসহ অন্যান্য ফসলও হয়। আখ থেকে বিশেষ এক ধরনের পণ্য তৈরি হয়, যাকে বলা হয় লাল চিনি।

২০২৫ সালে ৬৫০ হেক্টর জমিতে আখ হয়। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ জমিতে দেশী জাতের আখের আবাদ হয়। বাকি জমিতে ঈশ্বরদী-৪১ ও ঈশ্বরদী-৪২ জাতের আখ হয়। এক হেক্টর জমি থেকে প্রায় ৮ মেট্রিকটন লাল চিনি উৎপাদন হয়। লাল চিনি গড়ে ৮ হাজার টাকা মণ বিক্রি হয়।

এ বছর প্রায় ১০৮ কোটি টাকা লাল চিনি বিক্রি করে আয় করে কৃষকেরা। এক মেট্রিকটন আখ থেকে প্রায় ৩২ হাজার লিটার রস হয়। চার কেজি রস থেকে এক কেজি লাল চিনি বের হয়।

লাল চিনি সম্পূর্ণ ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে তৈরি হয়। চুলা পরিবর্তনের মাধ্যমে রস গুলো জাল করে, অনবরত হাতের মাধ্যমে ঘূর্ণায়মান করে চিনি উৎপাদন করা হয়। এটি সম্পূর্ণ অর্গানিক বলা যায়। যার কারণে, এটি শরবত বা মিস্টান্ন হিসেবে যখন পান করা হয় তখন কাঁচা রসের ফ্লেভার পাওয়া যায়। ফলে দেশে ও বিদেশেও এর চাহিদা রয়েছে। এ চিনিকে যারা চিনে তারা অনলাইনের মাধ্যমে বিদেশে নিচ্ছে।

ফুলবাড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আরিফুর ইসলাম বলেন, লাল চিনির জিআই স্বীকৃতির বিষয়টি আজ আমরা নিশ্চিত হয়ে সনদের জন্য টাকা জমা দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছি৷ এই স্বীকৃতিতে উচ্ছ্বসিত এ অঞ্চলের মানুষ। এই স্বীকৃতি এ অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।