দেশের প্রধান এবং সবচেয়ে ব্যস্ত বিমানবন্দর ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। প্রতিদিন এই বিমানবন্দর দিয়ে হাজার হাজার যাত্রী দেশে-বিদেশে যাতায়াত করে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এই বিমানবন্দরের ব্যস্ততা। তবে এখানে অত্যাধুনিক তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ করা হলেও এখনো একটি রানওয়ের ওপরই নির্ভরশীল বিমাবন্দরটি।
একটি মাত্র রানওয়ে হওয়ায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইটের চাপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। একদিকে উড়োজাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি অন্যদিকে অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং রক্ষণাবেক্ষণের চ্যালেঞ্জ দুর্ঘটনার ঝুঁকিকে আরও প্রকট করে তুলছে বলে জানিয়েছেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া চাপ বাড়ায় যাত্রীদেরও সময় নষ্ট হচ্ছে, পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে। এতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে এয়ারলাইন্সগুলোও।
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, এখন শাহজালালের রানওয়েতে প্রতিদিন কমবেশি ৩৬টি বিদেশি এয়ারলাইন্স, আটটি কার্গো এয়ারলাইন্স, চারটি দেশীয় এয়ারলাইন্স, হেলিকপ্টারসহ ১৩টি এভিয়েশন প্রতিষ্ঠান তাদের ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
শাহজালালের রানওয়ে এখন বাণিজ্যিকের পাশাপাশি বিভিন্ন বাহিনীর কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে। বিমান বাহিনীর ট্রেনিং বিমানও এখান থেকেই ওড়ে। ফলে দিন দিন চাপ বাড়ছে এই রানওয়ের। ফলে সঠিক সময়ে ছাড়তে পারছে না ফ্লাইট। এতে বিরক্ত হচ্ছেন যাত্রীরা। সম্প্রতি বেবিচকের এক গোপন প্রতিবেদনে এসব সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়েছে।
শাহজালালের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা মেইলকে বলেন, কোনো ভিভিআইপি বিদেশ থেকে এলে তার জন্য আধা ঘণ্টা রানওয়েতে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এটার প্রভাব পড়ছে এয়ারলাইন্সগুলোতে। তাদের বাড়তি ফি গুনতে হচ্ছে। অনেক দেশে পৃথক রানওয়ে থাকলেও এখানে সেটা নেই। ফলে চাপ বাড়ছে। সঙ্গে যাত্রীদের ভোগান্তিও বাড়ছে।
সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন কলেজ ক্যাম্পাসে একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর টনক নড়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। তারা এখন বিকল্প রানওয়ের কথা জোরালোভাবে ভাবছেন। এ নিয়ে সম্প্রতি দফায় দফায় বৈঠকও হয়েছে। বিমানবন্দরের পূর্ব বা পশ্চিম পাশ দিয়ে আরেকটি বিকল্প রানওয়ে তৈরির পরিকল্পনার কথা ভাবছে কর্তৃপক্ষ।
এছাড়াও রানওয়েতে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটের চাপ থাকলে প্রশিক্ষণ বিমানগুলো ওঠানামার জন্য বিকল্প রানওয়ে ব্যবহারের উদ্যোগও রয়েছে তাদের।
বাড়তি উড়োজাহাজ ও রানওয়ের সক্ষমতা
জানা গেছে, গত এক দশকে যাত্রী ও ফ্লাইটের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। প্রতি বছর শুধু হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই সাড়ে ১২ মিলিয়ন যাত্রী আসা-যাওয়া করেন। সেটি আগামী ১০ বছরে ২৫ মিলিয়নে দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে যাত্রী ও ফ্লাইটের চাপ আরও বাড়বে। প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে আড়াইশ ফ্লাইট ওঠানামা করে এই বিমানবন্দরে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই উড়োজাহাজের চলাচল বহুগুণে বেড়েছে। এতে বাড়তি চাপ পড়ছে রানওয়েতে। একটি ফ্লাইট এসে নামতে থাকলে আরেকটিকে ওড়ার জন্য বসে থাকতে হচ্ছে। আবার আকাশ থেকে একই সঙ্গে দুটি ফ্লাইটও নামতে পারছে না। মাঝ আকাশে চক্কর দিয়ে সময় কাটাতে হয়। সিগন্যাল পেলে সেটি নামার সুযোগ পায়। এভাবেই চলছে শাহজালালের রানওয়ের কার্যক্রম।
এভিয়েশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি মাত্র রানওয়ে দিয়ে এত বিপুলসংখ্যক উড়োজাহাজের ওঠানামা পরিচালনা করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে পিক আওয়ারগুলোতে। উড়োজাহাজের অবতরণের পর টার্মিনালে প্রবেশ এবং উড্ডয়নের জন্য প্রায়ই দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। যা পাইলট এবং এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল উভয়ের ওপরই চাপ বাড়ায়। ভুল বার্তা আদান-প্রদান, যোগাযোগের ত্রুটি এবং অতিরিক্ত মানসিক চাপ দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হতে পারে। উপরন্তু, রাডার ও নেভিগেশনাল সিস্টেমের আধুনিকীকরণের অভাবও এয়ার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে জটিল করে তুলেছে। পুরনো প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে খারাপ আবহাওয়ার সময় উড়োজাহাজের নিরাপদ অবতরণ ও উড্ডয়নে আরও বেশি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শাহজালাল বিমানবন্দরে চাপ বাড়ার নেপথ্যে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ার আধুনিক প্রযুক্তি এবং দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। সীমিতসংখ্যক এটিসি কর্মকর্তা এত বিপুলসংখ্যক উড়োজাহাজকে সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।
আমি বহুদিন থেকে বলে আসছি, এই এয়ারপোর্ট আমাদের ব্যবহার উপযোগী আর থাকছে না, যে হারে আমাদের যাত্রী বাড়ছে। আয়াটার তথ্যমতে, এখন শাহজালালে প্রতি বছর সাড়ে ১২ মিলিয়ন যাত্রী যাতায়াত করে। এটা আগামী ১০ বছরে দ্বিগুণ হবে। যাত্রী যদি দ্বিগুণ হয় তাহলে তো ফ্লাইটও দ্বিগুণ হবে। সেই দ্বিগুণ ফ্লাইট ওঠানামার জন্য রানওয়ে নেই।
রানওয়ের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণও কঠিন হয়ে পড়ছে
জানা গেছে, নিয়মিত এবং কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে রানওয়েতে ফাটল ও গর্ত বা অসমতার সৃষ্টি হতে পারে। যা উড়োজাহাজের টায়ারের জন্য বিপজ্জনক। যদিও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের কথা বলেন। কিন্তু রানওয়ের ওপর এত বাড়তি চাপের কারণে অনেক সময় সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এছাড়া পর্যাপ্ত ট্যাক্সিওয়ে না থাকায় উড়োজাহাজগুলোকে রানওয়ের ওপর দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। যা রানওয়ের ক্ষয়ক্ষতি বাড়ায় এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি সৃষ্টি করে। জরুরি অবতরণের ক্ষেত্রে বিকল্প রানওয়ের অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এটি কিছু দিনের মধ্যে চালু হতে পারে। যদিও এটি রানওয়ের ওপর চাপ কমাতে সরাসরি কোনো ভূমিকা রাখবে না। দ্বিতীয় রানওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা দীর্ঘদিনের হলেও এর বাস্তবায়ন এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
এখন তো একটি ফ্লাইট এলে আরেকটিকে দাঁড়িয়ে বা আকাশে থাকতে হয়। অনেক সময় রানওয়েতে জ্যাম থাকে, ফলে আকাশ থেকে নামতে পারে না। এর জন্য এয়ারলাইন্সগুলোর অনেক আর্থিক ক্ষতি হয়। যাত্রীদের সময় নষ্ট হয়। এটা ওভারঅল এভিয়েশন খাতে একটি বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে।
—কাজী ওয়াহেদুল আলম, এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ
এ বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহেদুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি বহুদিন থেকে বলে আসছি, এই এয়ারপোর্ট আমাদের ব্যবহার উপযোগী আর থাকছে না, যে হারে আমাদের যাত্রী বাড়ছে। আয়াটার তথ্যমতে, এখন শাহজালালে প্রতি বছর সাড়ে ১২ মিলিয়ন যাত্রী যাতায়াত করে। এটা আগামী ১০ বছরে দ্বিগুণ হবে। যাত্রী যদি দ্বিগুণ হয় তাহলে তো ফ্লাইটও দ্বিগুণ হবে। সেই দ্বিগুণ ফ্লাইট ওঠানামার জন্য রানওয়ে নেই।’
‘এখন তো একটি ফ্লাইট এলে আরেকটিকে দাঁড়িয়ে বা আকাশে থাকতে হয়। অনেক সময় রানওয়েতে জ্যাম থাকে, ফলে আকাশ থেকে নামতে পারে না। এর জন্য এয়ারলাইন্সগুলোর অনেক আর্থিক ক্ষতি হয়। যাত্রীদের সময় নষ্ট হয়। এটা ওভারঅল এভিয়েশন খাতে একটি বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে।’
যেহেতু শাহজালালের রানওয়েতে চাপ বাড়ছে, এর ফলে ঝুঁকি তৈরির শঙ্কা রয়েছে। এজন্য এই বিমানবন্দরকে অন্য কোথাও স্থানান্তরের পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘এই বিমানবন্দরকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করতে হবে। একটি বিমানবন্দর তৈরি করতেই ১০ থেকে ১৫ বছর লেগে যায়। আমরা এখন যদি সেই বিমানবন্দরটি তৈরিতে হাত দিই বা কাজ শুরু করি, তাও তো ১৫ বছরের আগে সমাধান সম্ভব নয়। শাহজালালের রানওয়ে এভাবে ব্যবহারে দিনে দিনে আরও ঝুঁকি বাড়বে। বড় ঝুঁকি তৈরি হলে সেটি এয়ারলাইন্স খাতের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।