দেশে প্রায় তিন বছরের বিরতি দিয়ে আবার করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়ছে। প্রতিদিনই অল্প করে হলেও শনাক্ত হচ্ছে। মারাও যাচ্ছে। করোনার যে উপধরনটি সম্প্রতি দেশে শনাক্ত হয়েছে এটি দ্রুত ছড়ায় এবং সংক্রমণ ঘটায়। কিন্তু এরপরও জনসাধারণের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বালাই নেই। সিংহভাগ মানুষ পরছেন না মাস্ক। সামাজিক দূরত্বসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারেও সবাই উদাসীন।
শুক্রবার (২৭ জুন) রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল, মার্কেট ও বিনোদনকেন্দ্র ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
রাজধানীর ধানমন্ডি লেকে আজিমপুর থেকে পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছেন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। তারা লেকের পারে বসে গল্প আর আড্ডায় মেতেছেন। অপেক্ষায় আছেন কন্যাকে নিয়ে নৌকায় চড়বেন। তবে এখন তাদের কাছে এখন স্বাস্থ্যবিধি মানার গুরুত্ব নেই। কেউ পরিধান করেননি মাস্ক।
জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, এখন আগের মতো করোনার সংক্রমণ নেই। কেউ আর সেভাবে করোনাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। যার কারণে মাস্ক পরা কিংবা স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। আর মাস্ক পরতে অস্বস্তিও লাগে। তবে মাঝে মাঝে ভয়ও লাগে যদি করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। তবে আমার বিশ্বাস আর আগের মতো করোনা ছড়াবে না।
শুধু তারা নন, ধানমন্ডি লেকে ঘুরতে আসা কাউকে মাস্ক পরতে দেখা যায়নি। কেউ মানছেন না সামাজিক দূরত্ব কিংবা স্বাস্থ্যবিধি।
এদিকে খোদ হাসপাতালেও স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা রয়েছে। অনেক রোগী মাস্ক পরলেও স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না হাসপাতালে রোগীর সঙ্গে আসা স্বজনরা। শরীয়তপুর থেকে অসুস্থ মাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া হাসান আলী। মায়ের চিকিৎসার সবকিছু দেখভাল করছেন তিনি ও তার ছোটভাই শরীফ উদ্দিন। তবে তাদের কাউকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে দেখা যায়নি, তাদের কারো মুখেও নেই মাস্ক।
জানতে চাইলে হাসান আলী বলেন, এই গরমে মাস্ক পরে আমি থাকতে পারি না। আর এখন অনেক ছোটাছুটি করতে হয়; এখন থেকে সেখানে যেতে হয়। যার কারণে মাস্ক পরতে ভালো লাগে না।
সরেজমিনে রাজধানীর কয়েকটি মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, মার্কেটে আসা মানুষের বেশির ভাগের মুখে নেই মাস্ক। তবে দুই-একজনকে মাস্ক পরতে দেখা গেছে। এছাড়া কেউই মানছেন সামাজিক দূরত্ব। মার্কেটগুলো রয়েছে ব্যাপক ভিড়, গাদাগাদি চলাফেরা করতেও দেখা গেছে। জনসাধারণ দুই-একজনকে মাস্ক পরা দেখা গেলেও দোকানদারদের মধ্যে কারো মুখে মাস্ক দেখা যায়নি।
করোনার নতুন এই ধরনটি একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে ছড়াচ্ছে। অনেক মানুষ আক্রান্ত হবে, তবে এই ধরন মারাত্মক নয়। আগের মতো ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হবে না। লকডাউন বা বিশেষ নিয়ম মেনে চলার কোনো দরকার নেই। তবে মাস্ক পরতে হবে এবং সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
—অধ্যাপক ডা. লেলিন চৌধুরী, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
জানতে চাইলে নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসাইন বলেন, মাস্ক পরি না তার একটা কারণ, আমার গরম লাগে এবং অস্বস্তিও লাগে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তার দোকান খোলা থাকে এবং এই পুরো সময়টাই প্রতিদিন কয়েকশ ক্রেতার সাথে কথা বলতে হয়।
এই বিক্রেতা বলেন, প্রতি মিনিটে আমাকে ক্রেতাদের সাথে কথা বলতে হয়। মাস্ক পরা থাকলে তারা আমার কথা বুঝতে পারে না। আর গরম তো আছেই, এসব কারণেই মাস্ক পরি না।
এদিকে চিকিৎসকরা বলছেন, জনগণ জনসমাগম এড়িয়ে চলা, স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন, মাস্ক পরিধান, বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস মানুষ ভুলতে বসেছে। জনসমাগম যেখানে বেশি হয় এমন স্থানে কোনো নির্দেশনা চোখে পড়ছে না। বাজার-শপিংমলে মাস্ক ছাড়া শত শত মানুষ একত্রিত হচ্ছে। যেহেতু নতুন উপধরণ দ্রুত ছড়ায় সেহেতু খারাপ পরিস্থিতির শঙ্কা থেকে যাচ্ছে। এখনই জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। উপধরনটির গতিবিধি বিষয়ে নজর রাখতে হবে। সেইসঙ্গে শনাক্তদের চিকিৎসায় জোর দিতে হবে।
তারা আরও বলছেন, বাংলাদেশে মাস্ক পরার প্রবণতা কম হওয়ার একটা বড় কারণ সচেতনতার অভাব। অনেকেই মনে করেন যে, মাস্ক না পরলেও তার কিছু হবে না। তবে সুরক্ষিত থাকতে হলে মাস্ক পরতে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
ভাইরাসজনিত সংক্রমণের হার বেড়েছে। করোনাভাইরাসের কয়েকটি নতুন সাব–ভ্যারিয়েন্ট এরই মধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের বিস্তার প্রতিরোধে দেশের সব স্থল, নৌ ও বিমানবন্দরের আইএইচআর ডেস্কগুলোয় নজরদারি ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়গুলো জোরদারে বিষয়ে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
—অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর, মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদফতর
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, করোনার নতুন এই ধরনটি একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে ছড়াচ্ছে। অনেক মানুষ আক্রান্ত হবে, তবে এই ধরন মারাত্মক নয়। আগের মতো ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হবে না। লকডাউন বা বিশেষ নিয়ম মেনে চলার কোনো দরকার নেই। তবে মাস্ক পরতে হবে এবং সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
এবিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, ভাইরাসজনিত সংক্রমণের হার বেড়েছে। করোনাভাইরাসের কয়েকটি নতুন সাব–ভ্যারিয়েন্ট এরই মধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের বিস্তার প্রতিরোধে দেশের সব স্থল, নৌ ও বিমানবন্দরের আইএইচআর ডেস্কগুলোয় নজরদারি ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়গুলো জোরদারে বিষয়ে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে স্বাস্থ্য অধিদফতর কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। সেগুলো হলো-
১. জনসমাগম যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন এবং উপস্থিত হতেই হলে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করুন।
২. শ্বাসতন্ত্রের রোগগুলো থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য মাস্ক ব্যবহার করুন।
৩. হাঁচি বা কাশির সময় বাহু বা টিস্যু দিয়ে নাক–মুখ ঢেকে রাখুন।
৪. ব্যবহৃত টিস্যুটি অবিলম্বে ঢাকনাযুক্ত ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ফেলুন।
৫. ঘন ঘন সাবান ও পানি কিংবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলুন (অন্তত ২০ সেকেন্ড)।
৬. অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ ধরবেন না।
৭. আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন এবং কমপক্ষে ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রাখুন।
সন্দেহজনক রোগীদের ক্ষেত্রে করণীয়-
১. জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হলে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বাড়িতে থাকুন।
২. রোগীর নাক–মুখ ঢাকার জন্য মাস্ক ব্যবহার করতে বলুন।
৩. রোগীর সেবাদানকারীরাও সতর্কতা হিসেবে মাস্ক ব্যবহার করুন।
৪. প্রয়োজন হলে কাছের হাসপাতালে অথবা আইইডিসিআর (০১৪০১–১৯৬২৯৩) অথবা স্বাস্থ্য বাতায়ন (১৬২৬৩)–এর নম্বরে যোগাযোগ করুন।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের মার্চের শুরুতে দেশে করোনাভাইরাস হানা দেয়। ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর খবর আসে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত করোনায় দেশে মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার ৫১৯ জনের। এর মধ্যে এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ২০ জন। দেশে মোট ২০ লাখ ৫২ হাজার ৭৩ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন ৫২৮ জন।